কেবল প্রাণ নয়, উদ্ভিদের স্নায়ুতন্ত্রও আছে; প্রমাণ দিলেন তিন বাঙালী বিজ্ঞানী।

কেবল প্রাণ নয়, উদ্ভিদের স্নায়ুতন্ত্রও আছে; প্রমাণ দিলেন তিন বাঙালী বিজ্ঞানী।

দৈনিক সংবাদ অনলাইন।।  আঘাত , তাপ , চড়া আলো প্রভৃতি বাহ্যিক উদ্দীপকগুলি গ্রহণের জন্য মানুষের শরীরে থাকে আয়নোট্রপিক গ্লুটামেট রিসেপ্টর । উদ্ভিদের শরীরেরও একই ধরনের গ্লুটামেটধর্মী গ্রাহক বা রিসেপ্টরের খোঁজ দিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী ত্রয়ী । উদ্ভিদ এবং মানুষ বা স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সৃষ্টির পর থেকে পৃথক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে । তা সত্ত্বেও দু'টি জীবের মধ্যেকার সঙ্কেত গ্রহণ এবং পরিবহণ প্রক্রিয়ায় অদ্ভুত মিল দেখে অবাক হলেন ওই তিন বঙ্গ বিজ্ঞানীরা ।

বাহ্যিক যে কোনও স্টিমুলাস বা উদ্দীপক মানুষ গ্রহণ করে বিশেষ কিছু রিসেপ্টর বা গ্রাহক কোশের মাধ্যমে । সেরকম ২১ টি স্টিমুলাস প্রোটিনকে চিহ্নিত করেছিলেন গবেষকরা । অ্যারাবিডপসিস থালিয়ানা নামের উদ্ভিদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল এই ২১ টি স্টিমুলাস প্রোটিন । আর সেখানে দেখা গিয়েছে , এই ধরনের স্টিমুলাস প্রোটিনের রিসেপ্টর প্রোটিন রয়েছে উদ্ভিদের মধ্যে ।

বিষয়টা ঠিক তড়িৎবিজ্ঞানের মতো । বিদ্যুৎ পরিবহণে যেমন নেগেটিভ আর পজিটিভ মাধ্যমের প্রয়োজন হয় , ঠিক তেমনই উদ্দীপনার পরিবহণে প্রয়োজন স্টিমুলেন্টের গ্রাহক এবং কারক কোশের । এর মাঝে পরিবহণের মাধ্যমে বা কন্ডাক্টর হিসাবে কাজ করে বাহক কোশ । এতদিন মানুষসহ সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উদ্দীপনা গ্রহণে , পরিবহণে এবং সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে এই তিন কোশের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। এবার সেই ত্রয়ী কোশের সম্ভার মিলল উদ্ভিদদেহে । 

উদ্ভিদের দেহে মিলেছে ১৯ টি প্রোটিন রিসেপ্টর । কোনও প্রোটিনই অ্যামাইনো অ্যাসিডের শৃঙ্খল দিয়ে তৈরি । মানুষের শরীরে থাকা রিসেপ্টর প্রোটিনগুলির অ্যামাইনো অ্যাসিড শৃঙ্খলের সঙ্গে উদ্ভিদের ওই অংশের শৃঙ্খলগুলির অদ্ভুত মিল খুঁজে পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষক অন্তরা সেনগুপ্ত , ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অ্যাপ্লায়েড স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শুভদীপ চক্রবর্তী । আর এই প্রোটিন শৃঙ্খল দেখে তারা নিশ্চিত উদ্ভিদের শরীরেরও স্নায়ুতন্ত্র হয় ।

বাহ্যিক উদ্দীপনা সংকেত গ্রহণ ছাড়াও উদ্ভিদের শরীরে কচি কাণ্ড বা পাতার আবরণী কলাতে থাকা স্টোমাটাল রেগুলেশন , পোলেন টিউবের বৃদ্ধি প্রভৃতির জন্য দায়ী থাকে এই স্নায়ুতন্ত্র । যেখান থেকে বিজ্ঞানীরা একেবারে নিশ্চিত গাছেরও ব্যথা লাগতে পারে , প্রচণ্ড চড়া রোদে তারাও হাঁপিয়ে উঠতে পারে আবার বর্ষার জল পেয়ে যেমন ব্যাঙের স্নায়ুতন্ত্রে প্রজননের উদ্দীপনা জেগে ওঠে তেমনটাই ঘটে উদ্ভিদের শরীরেও । । আর সেই জন্যই বর্ষায় উদ্ভিদের দ্রুত শাখা - প্রশাখা সম্প্রসারণ ঘটে বলে মনে করছেন অন্তরা সেনগুপ্ত ।

মানুষের শরীরের যে ‘ গাবা ’ রিসেপ্টর থাকে , উদ্ভিদের শরীরেও সেরকম অ্যালুমিনিয়ামজাত ট্রান্সপোর্টারকে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন তারা । অন্তরা বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তড়িৎ পরিবহণের উদাহরণ টেনে বলেছেন , শুষ্ক বায়ু যেমন আয়ন পরিহণের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম , ঠিক তেমনই বর্ষার জল পেলেই উদ্ভিদের মধ্যে থাকা অ্যালুমিনিয়ামজাত ট্রান্সপোর্টার কোশগুলিও দ্রুত পরিবাহীর ভূমিকা নেয় । ফলে বর্ষার পরেই গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় ।

গাছেরও প্রাণ আছে । ১৯০১ সালে সেই প্রমাণ দিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন বরেণ্য বাঙালি পদার্থবিদ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু । তিনি গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন , উদ্ভিদের উপর বিভিন্ন প্রকার বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে ইলেক্ট্রন প্রবাহের ঘটনা ঘটতে পারে । একে এক সময় ‘ রাসায়নিক ক্রিয়া ’ হিসেবে বর্ণনা করা হতো । তিনি এই ধারণাকে পরবর্তীকালে পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন এটা কোনও রাসায়নিক ক্রিয়া নয় , অনুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া ' । সেই গবেষণার ধারাকে আরও একধাপ এগিয়ে দিলেন তিন বাঙালি গবেষক । প্রাণীর মতো স্নায়ুতন্ত্র না থাকা সত্ত্বেও বাহ্যিক উদ্দীপকে উদ্ভিদের দেহে সংকেত গ্রহণ ও প্রবাহের রহস্য উদ্ঘাটন করলেন তারা । আর সেই প্রক্রিয়ার জৈব রাসায়নিক পদ্ধতি মানুষের চেয়ে সামান্য ঊনিশ - বিশ হলেও পুরোপুরিভাবে আলাদা নয়।

এই প্রথমবার উদ্ভিদের কলা বা টিস্যুর উপর মাইক্রোওয়েভের প্রভাব এবং এর ফলে কোশ মেমব্রেনের বিভব পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করলেন তিন বিজ্ঞানী । কোশ মেমব্রেনের বিভব বলতে শুভদীপবাবু বুঝিয়েছেন , কোশের অন্তঃত্বক ও বহিঃত্বকের ভিতর ঘটে যায় তড়িৎ বিভবের পার্থক্য । আর দুই স্তরের এই বিভব পার্থক্য যেকোনও অনুভূতি বা বার্তা গ্রহণ করে ।

উদ্ভিদরাজি কেবল ব্যথা অনুভব করতে সক্ষম নয় , আনন্দ অনুভব করতে সক্ষম , এমনকী স্নেহ অনুভব করতেও সক্ষম । বঙ্গের ত্রয়ী বিজ্ঞানী আরও প্রমাণ করলেন যে, উদ্ভিদের একটি সঠিক জীবনচক্র এবং প্রজননতন্ত্র রয়েছে যা প্রাণীর অনুরূপ। তার এই গবেষণাপত্র এখন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে স্থান করে নিল তবে উদ্ভিদের মস্তিষ্ক বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ধারণা এখনও দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা । যদি গাছের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র না থাকে তাহলে উদ্ভিদ কিন্তু নেতিবাচক উদ্দীপনাতে বিচলিত হবে না , অবশ্য এখনও গোটা বিষয়টি গবেষণাসাপেক্ষ বলে জানিয়েছেন পবিত্রবাবু ।

‘ উদ্ভিদ স্নায়ুতন্ত্র ’ নামে প্রথম যিনি আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি চার্লস ডারউইন। তবে তিনি 'উদ্ভিদ স্নায়ুতন্ত্র’কে তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন । তাকে যুক্তিতে নয় , পরীক্ষাগারের রাসায়নিক পদ্ধতি তা প্রমাণ করেননি , যা করে দেখালেন এই তিন বাঙালি বিজ্ঞানী ।

সম্পরকিত খবর