কাউকে সাপের কামড়ে মরতে দেব নাঃ গিরি।

কাউকে সাপের কামড়ে মরতে দেব নাঃ গিরি।

দৈনিক সংবাদ অনলাইন।।  যতদিন দেহে আছে প্রাণ , শরীরে থাকবে জীবনীশক্তি , ততদিন আসামের একটি মানুষকে তিনি সাপের কামড়ে মরতে দেবেন না । এমনই অলিখিত আকাশ - বাণীকে অঙ্গীকারবদ্ধ আসামের চিকিৎসক সুরজিৎ গিরি । নিজে অ্যানেস্থেশিয়োলজিস্ট । এ পর্যন্ত ১২০০ সাপে কাটা রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে কার্যত ‘ নায়ক ’ হয়ে উঠেছেন তিনি । ডাক্তার গিরি নিজে বলেন , ' আমার জীবনের মূলমন্ত্র কবিগুরুর সেই অমোঘ বাক্য- চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির ।'

চিকিৎসককে মানবসেবাও বলা হয় । রোগীরা চিকিৎসককে দেবজ্ঞানে শ্রদ্ধা করেন । মরণাপন্ন মানুষের কাছে চিকিৎসকই সাক্ষাৎ দেবতা । সব পেশায় যেমন ভাল - মন্দ রয়েছে , তেমনই একশো শতাংশ চিকিৎসক যে তাদের পেশাকে মানবসেবা মনে করেন , তেমনও নয় । কিন্তু ডাক্তার সুরজিৎ গিরি প্রকৃতই চিকিৎসক । শুরুটা হয়েছিল ২০০৮ সালে । এক রাতে গোখরো সাপের দংশন খান এক তরুণী । তড়িঘড়ি তাকে ডিব্রুগড়ের একটি বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । কিন্তু সাপে কাটা রোগীদের উন্নত চিকিৎসা করার মতো পরিষেবা না থাকায় ওই তরুণীকে রেফার করা হয় ডিব্রুগড় মেডিক্যাল হাসপাতালে । কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই পথে মারা যান রোগী । হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর শংসাপত্র লেখেন ডাক্তার গিরি । চোখের সামনে তরুণীর নীলাভ মৃতদেহ দেখে কার্যত বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন তিনি । মনের ভিতর সিদ্ধান্ত নেন , সাপে কাটা রোগীদের বাঁচানোই হবে তার জীবনের অন্যতম ব্রত । এর পরেই সাপের কামড় এবং অ্যান্টিভেনম চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে তিনি বিস্তর পড়াশোনা শুরু করেন । শপথ নেন , প্রাণ থাকতে তিনি আসাম S রাজ্যের একজন মানুষকেও সাপের কামড়ে মরতে দেবেন না । সেই থেকে যখন যেখানে সাপে - কাটার খবর পেয়েছেন , রাত - বিরেত উপেক্ষা করে আর্ত রোগীদের পাশে ছুটে গেছেন ডাক্তারবাবু । এ পর্যন্ত ১২০০ সাপে- কাটা রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার গিরি । এখন তাকে গোটা আসামের সর্পদংশনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলা হয় ।
নিজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সুরজিৎ গিরি সংবাদমাধ্যমকে বলেন , সেটা ২০০৮ সাল । তখন আমি ডিব্ৰুগড় মেডিক্যাল কলেজ থেকে সবে ডাক্তার হয়ে বদলি হয়ে গেছি শিবসাগর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ডিমো হেলথ সেন্টারে । ওই এলাকায় বিষাক্ত সাপের খুব উপদ্রব ছিল । গ্রামে রোজ অন্তত একজন ব্যক্তি সাপের কামড়ে আক্রান্ত হতেন । অথচ আমাদের হাসপাতালে সাপে কাটার চিকিৎসার উন্নত পরিকাঠামো নেই । গ্রামবাসীদেরও আমাদের হাসপাতালের প্রতি ভরসা ছিল না । কাউকে সাপে কাটলেই তাকে নিয়ে যাওয়া হতো স্থানীয় ওঝাদের কাছে । তাতে অধিকাংশ রোগী মারা যেতেন । আমার বয়স তখন পঁচিশ ছাব্বিশ । সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্ব তখন আমার কাঁধে । বছর পঞ্চাশের এক কৃষক সাপের কামড়ে ছটফট করতে করতে হাসপাতালে আসেন । আমি দেখে বুঝতে পারি , এটা বিষাক্ত চন্দ্রবোড়া সাপের কামড় । আমার চিকিৎসায় ওই রোগী সুস্থ হন । অ্যান্টিভেনম দিয়ে রোগীকে পর্যবেক্ষণে রেখে তার প্রাণ বাঁচাই । তারপর থেকেই গ্রামবাসীদের মধ্যে ডাক্তারদের সম্পর্কে ভরসা তৈরি হয় । মাসে দুই - একজন করে রোগী আসতে শুরু করেন । এখন মাসে অন্তত ৬০-৬৫ জন রোগী আসেন সাপের কামড় খেয়ে । ’ উল্লেখযোগ্য বিষয় হল , সাপের দংশনে আক্রান্তদের সকলকে বাঁচান ‘ গিরি ডাক্তার ’ । তার কথায় , ‘ আসামের গ্রামাঞ্চলে সাপের দংশন নিত্য - নৈমিত্তিক ঘটনা । বিষধর সাপেরও কমতি নেই গ্রামগঞ্জে । সাপের কামড় খেয়ে ছটফট করতে করতে হাসপাতালে আসেন । সেই রোগীকে সুস্থ করার পর তার মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠার যে তৃপ্তির হাসি দেখি , এখন ওটাই আমার জীবনের পাথেয় । চিকিৎসক হিসাবে জীবনের সার্থকতাও । '
ডিমো হেলথ সেন্টারে গিরি ডাক্তারের সৌজন্যে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ওয়ার্ড তৈরি হয়েছে । ডাক্তারবাবুর উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করেছেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ । বাড়ির কাউকে সাপে কামড়ালেই ওই গ্রুপে জানানো যায় । ডাক্তার গিরিকে সরাসরি হোয়াটসঅ্যাপ করেও রোগীরা যোগাযোগ করতে পারেন । তার উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে ‘ ফাস্ট রেসপন্স গ্রুপ । এখনও পর্যন্ত সাপে কাটা ১২০০ রোগীকে অ্যান্টিভেনম চিকিৎসা পদ্ধতিতে সুস্থ করে তুলেছেন তিনি , তার মধ্যে ৫৩ জন রোগীকে কামড়ে ছিল বিষধর গোখরো ।

সম্পরকিত খবর