নবজাতকের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের সুস্থ নাগরিক।

নবজাতকের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের সুস্থ নাগরিক।

দৈনিক সংবাদ অনলাইন।।    মাতৃগর্ভে সৃষ্টির প্রথম মুহূর্ত থেকেই প্রকৃতি একটি ভ্রুণকে সঠিক পদ্ধতিতে গড়ে তোলে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার জন্য । 
মাতৃজঠরে সর্বপ্রথম গঠিত হওয়া পূর্ণ অঙ্গটি হল হৃদপিণ্ড। এটি ভ্রুণের উনিশ দিন বয়স থেকে দেড় মাসের মধ্যে তৈরি হয় এবং অন্যান্য অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন করে । সঠিক সময়ে তৈরি হওয়া সঠিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একটি ভ্রুণকে পূর্ণতা দেয়।
জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নবজাতকের রক্ত সঞ্চালন একটি বিশেষ পরিবর্তনের সম্মুখীন হয় । মাতৃজঠর বাসকালে ফুসফুসীয় ধমনী রক্ত সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই ফুসফুস সক্রিয় হয়ে উঠলে মহাধমনী সক্রিয় হয় । এই পরিবর্তন অনেক সময় নানা কারণে সঠিক ভাবে হয় না । জন্মের পর একটি নবজাতকের এটিই সর্বাধিক বড় চ্যালেঞ্জ।
একশোতে দশটি শিশুর জন্মের পর কাঁদতে দেরি হয় , অর্থাৎ ফুসফুস সক্রিয় হয় না। এই সময় প্রথম এক মিনিটকে ফাস্ট গোল্ডেন মিনিট বলে ধরা হয় । সহায়তার মাধ্যমে ফুসফুস থেকে জল সরিয়ে তৎপরতার মাধ্যমে শ্বাস - প্রশ্বাস শুরু করার পদ্ধতির নামই নবজাতকের রিসাসিটেশন । এই পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম । সব প্রসব কেন্দ্রেই একটি নবজাতকের রিসাসিটেশন জানা একটি দল থাকা আবশ্যক । অধিকাংশ শিশুই সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমেই শ্বাস - প্রশ্বাস নিতে শুরু করে । এর জন্য খুব মূল্যবান সামগ্রীর প্রয়োজন হয় না । যে কোনও প্রত্যন্ত প্রসব কেন্দ্রেই এই চিকিৎসা সম্ভব । এইসব সামগ্রীর মাধ্যমে শ্বাস নেওয়া শিশুরা সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের কাছে থাকতে পারে । কিছু কিছু ক্ষেত্রেই বিশেষ যত্ন প্রয়োজন ।
 জন্মের পর একটি নবজাতক আরও যে একটি সমস্যার সম্মুখীন হয় , তা হল হাইপোথার্মিয়া বা নিম্ন তাপমাত্রা । মায়ের গর্ভের উষ্ণ , আরামদায়ক পরিবেশ থেকে এসে বাইরের পৃথিবীর রুক্ষ পরিবেশ শিশুর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে । শিশুর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্রাউন এডিপোস কোষ কম থাকায় শিশুকে অধিক উষ্ণ এবং আর্দ্র পরিবেশে রাখা প্রয়োজন । তাই প্রসব কক্ষের তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হওয়া প্রয়োজন । শিশুকে জন্মের পরই ভেজা কাপড় থেকে সরিয়ে আগে থেকে গরম করে রাখা কাপড়ে আপাদমস্তক জড়িয়ে নেওয়া জরুরি । এর আগে শিশুর সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিকতা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত । শিশুর মাথার সারফেস এরিয়া শরীরের তুলনায় বেশি হওয়ায় সুতির কাপড়ে মাথা ঢেকে রেখে তাপমাত্রা হ্রাস রোধ করা উচিত । নিয়ম মতো জন্মের পর প্রথম আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে একবার অন্তত মূত্রত্যাগ এবং প্রথম চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মলত্যাগ করা উচিত । অন্যথা হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
শ্বাস - প্রশ্বাস , তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পর বেঁচে থাকার জন্য শিশুর প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি । এই সঠিক পুষ্টির আধার হল মাতৃদুগ্ধ । জন্মের প্রথম আধঘণ্টার মধ্যে সুস্থ শিশুকে মাতৃস্তনদান একান্ত জরুরি । স্তন্যপান এক ধরনের প্রতিবর্ত ক্রিয়া । শিশুর স্পর্শ , গন্ধ , দৃশ্য মায়ের স্তনে দুগ্ধ নিঃসরণ ঘটায় । সঠিক সময়ে জন্মানো নবজাতক স্তনপানের রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্তের মাধ্যমেই স্তনপান করে । প্রথম আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘন , আঠালো , হলদেটে দুধকে বলা হয় লিক্যুইড গোল্ড বা তরল সোনা , যার নাম কোলোস্ট্রাম বা শালদুধ । এই দুধ পরিমাণে কম হলেও প্রচুর পরিমাণ রোগ প্রতিষেধক বা ইমিয়ুনোগ্লোবিউলিনে সমৃদ্ধ হয় । তাই এই দুধ থেকে শিশুকে বঞ্চিত করা নৈব নৈব চ । প্রকৃতি শিশুর ওজন , বয়স এবং পরিপূর্ণতার নিরিখে মায়ের দুধে এনার্জি , প্রোটিন মেপে মেপে দেয় । তাই পুষ্টির অভাব কখনওই হতে পারে না । মায়ের দুধ পান করা শিশু চব্বিশ ঘণ্টায় আটবার স্তনপান করলে এবং ছয়বার মূত্রত্যাগ করলে মায়ের দুধের পরিমাণ যথাযথ বলে ধরা হয়।
সঠিক পুষ্টির পর আমাদের কাজ হচ্ছে শিশুকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। পাতলা চামড়া, কম রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শিশুকে যে কোনও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের শিকার করে তোলে । শিশুর শরীরের সংক্রমণ তীব্র অবস্থায় পৌঁছাতে সময় বেশি লাগে না । এবং এই সংক্রমণ মস্তিষ্কেও ঢুকে যায় খুব তাড়াতাড়ি । শিশুর মস্তিষ্কের সংক্রমণ হলে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও ভবিষ্যতে সমস্যার অবকাশ থেকেই যায় । মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ একবার আক্রান্ত হলে আর সেরে ওঠে না । তাই সংক্রমণের সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন ।
নবজাতকের আরেকটি খুব সাধারণ অসুখ হল জন্ডিস । শিশুর লোহিত রক্তকণিকার ধ্বংসের হার বড়দের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় জন্ডিস বাড়ে খুব দ্রুত । তবে এই জন্ডিস ফোটোথেরাপি অর্থাৎ অধিক তীব্র নীল আলোর মাধ্যমে কমানো হয় । কিন্তু বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি হলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ঢুকে যায় । এর ফলে ভবিষ্যতে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় । শিশুর মানসিক এবং সার্বিক বেড়ে ওঠা বাধা পায় । কার্নিক্টেরাস নামে এই অসুখ শিশুদের স্নায়ুঘটিত অস্বাভাবিকতার অন্যতম কারণ ।
শিশুর জন্ম একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া । কিন্তু জন্মের সময় এবং পরে শিশুর স্নায়ুকোষের সুরক্ষাই সবচেয়ে মোক্ষম পরিচর্যা । আমাদের ভুলে গেলে চলবে না , দীর্ঘ ন'মাস সন্তানধারণের পর একজন মা শিশু কোলে নিয়ে বাড়ি গেলে আমাদের দায়িত্ব শেষ হবে না , সেই শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ হতে হবে । তাই প্রয়োজন নবজাতকের সঠিক পরিচর্যা পৃথিবীকে সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে এবং এগিয়ে রাখার সিংহদায়িত্ব প্রকৃতিই সম্পাদন করে । আমাদের শুধু প্রকৃতিকে সঠিক উপায়ে সহযোগিতা করতে হবে । এর জন্য চাই কিছু নিরবিচ্ছিন্ন ট্রেনিং , দায়িত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা , প্রসূতিকাল থেকেই নবজাতকের সমস্যা , স্তনপান নিয়ে মাকে ওয়াকিবহাল করা সুস্থ নবজাতক ভবিষ্যতের নাগরিক । এই দায়ভার স্বাস্থ্যকর্মী থেকে সমাজকর্মী এবং পারিবারিক স্তরে যত দ্রুত এবং সঠিকভাবে গ্রহণ যোগ্য হয় ততই মঙ্গল ।
                                                                                                                                                                         ডাঃ গোপা চ্যাটার্জি ( শিশু বিশেষজ্ঞ, আই জি এম হাসপাতাল)

সম্পরকিত খবর