রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান

রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান

একটি ২৫ শে বৈশাখ। বিশ্বকবির আরও একটি জন্মদিন। সেইসাথে কবির বয়সের সাথে আরও একটি সংখ্যা যুক্ত হল। আরও একটি দিন আমরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে কবিবন্দনায় মেতে আছি, মেতে থাকবো। স্কুল-কলেজ, পাড়ায়-ক্লাবে কবিকে স্মরণ করা হচ্ছে। হয়তো সারাদিন ধরেই চলবে। যদিও পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে কবি চর্চার ধারা এখন অনেকটাই কমে গেছে। গত কয়েকবছর আগেও ২৫ শে বৈশাখের সকাল থেকে দিনভর আট থেকে আশির মধ্যে যে উন্মাদনা লক্ষ্য করা যেতো, এখন সেই উন্মাদনার অনেকটাই ভাটা পড়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, বছরের এই একটি দিনই কেন আমরা কবিবন্দনায় মেতে থাকবো? বছরের অন্য দিনগুলোতে কেন আমরা রবীন্দ্রভাবনার কাছাকাছি থাকবো না? সময় এসেছে নিজেদের এই প্রশ্ন করার এবং উত্তর খোঁজার। ২৫ শে বৈশাখের সকালে ধুমধাম করে রবীন্দ্র জয়ন্তী উদ্যাপন, আর নমঃ নমঃ করে ২২ শে শ্রাবণ (মৃত্যুদিবস) পালনের মাধ্যমেই কি সব শেষ? স্কুল-কলেজের সিলেবাসে কিছু গল্প-কবিতার সংযোজন করেই কি রবীন্দ্রনাথকে জানা যাবে? উত্তর- অবশ্যই 'না'। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্র গবেষক মনিমা মজুমদার তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, "আমরা রবিঠাকুরের গান শুনছি, কবিতা পড়ছি, প্রবন্ধ পড়ছি। কিন্তু কতটা আত্মস্থ করছি? কতটাই বা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছি? রবীন্দ্রনাথ তো শুধু একটি নাম নয়, একটি চেতনা-একটি ভাবনাও। আমরা সেই চেতনা বা ভাবনাকে কতটা সততার সঙ্গে বহন করছি, সেটাই বড় ভাবনার বিষয়। আজকের তরুন প্রজন্ম যতটা সামাজিক মাধ্যমে সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, ততটা বইয়ের পাতা উল্টাতে করেনা। উল্টালে বুঝতে পারত, মৃত্যুর এত বছর পরেও কেন রবীন্দ্রনাথ এতটা প্রাসঙ্গিক। এই প্রসঙ্গিকতা যে নবীন ও বর্তমান প্রজন্মকে সেভাবে নাড়া দিচ্ছেনা, আকৃষ্ট করছে না, সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বর্তমান প্রজন্ম তথ্য প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং তাতেই আকৃষ্ট । যে কারণে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্র চর্চা। নবীন ও বর্তমান প্রজন্ম আগ্রহ হারাচ্ছে"। 
তিনি আরও লিখেছেন, "আদর্শ ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার প্রতিফলন রবীন্দ্রনাথ রেখে গেছেন তাঁর সুবিশাল সৃষ্টিতে। আজকের অস্থির সমাজের কাছে সেই সৃষ্টি অতি অল্প সময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। এক্ষেত্রে কাজ শুরু হয়েছে। অনেকটা এগিয়েছেও। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তারপরও একটা সংশয় থেকে যায়।"
এবছর রবি ঠাকুরের ১৬১ তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কালে তাই বলতে হচ্ছে, এই সংশয় দূর করতে না পারলে অচিরেই হয়তো 'রবিঠাকুর' শুধুমাত্র একটি নাম হয়ে আগামী প্রজন্মের কাছে বিবেচিত হবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি এমনিতেই প্রতিকূলে। গত দুই বছর করোনা মহামারিতে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। পরিস্থিতিই বাধ্য করছে নবীন-প্রবীন সকলকে আরও বেশি করে তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল হয়ে উঠতে। কেরিয়ার গড়ার হঁদুরদৌড়ে আমরা সকলেই ছুটছি। এই দৌড় অব্যাহত আছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও তেজি হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে এই সবকিছুই অসম্ভব। এই বিশ্বের যা কিছু সুখ, উৎসব, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, মহাসঙ্কটে আজও রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের আশ্রয়। তাই তাঁকে মননে, চিন্তনে, ভাবনায় ধারণ করতে পারলে সমৃদ্ধ হবে দেশ-জাতি। একই সাথে আমরাও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুঁজে নিতে পারবো রবীন্দ্রনাথকে।

সম্পরকিত খবর